২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভিক্টোরিয়া পার্ক : ঐতিহ্যের স্মারক

ভিক্টোরিয়া পার্ক : ঐতিহ্যের স্মারক - ছবি : নয়া দিগন্ত

পুরান ঢাকার সদরঘাটের কাছে লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্কের প্রথম পরিচিত ছিল ‘আণ্টাঘর’ নামে। ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল এখানে। তারা এখানে পুল খেলত। স্থানীয়রাডিমের মতো দেখতে হওয়ায় বলটিকে 'আন্ডা' বলে ডাকত। সে থেকে মাঠটি পরিচিত হয়ে উঠে ‘আণ্টাঘর’ নামে।১৮৫৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণের পর এই ময়দানের নাম রানির নামানুসারে ভিক্টোরিয়া পার্ক করা হয়। ১৯৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষে ব্রিটিশদের হাতে মারা যাওয়া সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মাধ্যমে এর নাম পরিবর্তন করে বাহাদুর শাহ পার্ক রাখা হয়। ব্রিটিশদের হাতে পরাজিত হওয়া সর্বশেষ সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ-এর নাম অনুসারে এ পার্কের নামকরণ করা হয়। তবে ঐতিহ্যবাহী এ পার্কটি এখনো জনসাধারণের নিকট ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’ নামেই প্রচলিত রয়েছে। এ পার্কটির আয়তন ৮৫.৩ কাঠা।

ঐতিহ্যবাহী ভিক্টোরিয়া পার্কটি আশেপাশের মানুষের একটি অন্যতম বিশ্রামের জায়গা হয়ে উঠেছে। এছাড়াও সদরঘাট, আদালত এলাকায় আসা দেশের নানা প্রান্তের মানুষের কাছে ভিক্টোরিয়া পার্কটি অতিপরিচিত বিশ্রাম নিতে ও বসার জায়গা হিসেবে।পার্ক এলাকার আশেপাশের স্থানীয় মানুষজন এখানে সকাল-বিকাল হাঁটেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ২০০ বছরের পুরনো এ পার্কটিকে সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিকায়ণ করেছে। এতে ব্যয় হয়েছে ছয় কোটি ৬৮ লাখ টাকা। ২০২০ সালের মার্চে সংস্কার কাজ শেষ করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।

বর্তমানে পার্কটির ভেতরে ও বাইরে চারদিকে ওয়াক ওয়ে বা হাঁটার পথ করা হয়েছে। তবে বাইরের হাঁটার পথে বসেছে নানা দোকান। এখানেরয়েছে কয়েকটি চায়ের দোকান, একদিকে ফুটপাত জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন ফলের দোকান। এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতির দোকান, পিঠা, ডাব, ওজন মাপার যন্ত্র ইত্যাদি। এগুলোর ফলে হাঁটাই যায় না। এখানে যে বেঞ্চগুলো রয়েছে সেগুলো দোকানগুলোতে বসার জন্যই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়াও ভেতরের যে হাঁটার পথ রয়েছে সেখানেও বসে নানা ধরণের দোকান। সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে বসেছে ঝাল মুড়ি, ফুচকা, সিম কোম্পানির আউটলেট, স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার বিভিন্ন ছোট ছোট দোকান। ফলে ভেতরেও হাঁটা কষ্টকর।

পার্কটির ভেতরের মাঠের একটি বড় অংশে করা হয়েছে ক্যাফে বাহাদুর নামে একটি রেস্টুরেন্ট। এতে খেলার জায়গা কমে গেছে।পার্কে মানুষ আসবে ব্যায়াম করার জন্য, সময় কাটানোর জন্য। এখানে রেস্টুরেন্ট করে মাঠটি সংকুচিত করা একেবারেই ঠিক হয়নি। এছাড়াও পার্কের ভেতরে বাইক পার্কিং করে স্থানীয়রা। ফলে পার্কটিতে মানুষের বসার জায়গা সংকুচিত হয়ে এসেছে।

এখানে সকালে ব্যায়াম করতে আসা রফিক হাসান জানান, ‘ভোরবেলা একটু হাঁটার জায়গা থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে এখানে মানুষের চাপে ও বিভিন্ন ছোট ছোট দোকানের যন্ত্রণায় হাঁটা যায় না। পার্কটিকে এমনভাবে সংস্কার করা হয়েছে যে এখানে অনেক বেশি মানুষ একসাথে হাঁটতেই পারছে না। এটিকে আরো খোলামেলাভাবে সংস্কার করা উচিত ছিল। পার্কে মানুষ ঘুরতে আসবে, একটু সময় কাটাবে। যার জন্য খোলা জায়গা রাখার দরকার ছিল।‘

এছাড়াও পার্কের একপাশে নানা ধরণের গাছ লাগানো হয়েছে, যেগুলো পরিচর্যার অভাবে মৃতপ্রায়। এখানে একটি পাবলিক টয়লেটের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু যথাযথ পরিষ্কারের অভাবে এগুলো ব্যবহার করাই হচ্ছে না। এছাড়াও এখানে টাকা দিয়ে ব্যবহার করতে হয় বলে আশেপাশের বাস ও রিক্সাচালকরা পার্কটির একটি অংশে প্রস্রাব করছে। এতে নষ্ট হচ্ছে পার্কের পরিবেশ। এত টাকা ব্যয় করে টয়লেট করা কোনো কাজেই আসছে না।

পার্কটিতে অনেক গাছ থাকলেও নেই কোনো ঘাস। একটু সবুজের ছোঁয়া পেতে আশেপাশের এলাকা থেকে এখানে মানুষ ছুটে আসে। তবে এখানে কোনো ঘাস না থাকায় সবুজের সান্নিধ্যে আসা সম্ভব হচ্ছে না। মানুষ বিকেলে ঘাসে বসে আড্ডা দিবে, সময় কাটাবে। কিন্তু পার্কটিকে এমনভাবে সংস্কার করা হয়েছে যে এখানে খোলামেলাভাবে ঘাসের উপর বসে আড্ডা দেয়ার কোনো জায়গা নেই।

পার্কে ঘুরতে আসা সোহেল হাসানের সাথে কথা বললে তিনি জানান, ‘পার্কটিতে ব্রিটিশদের হাতে নিহত সৈনিকদের স্মরণে যে স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে তার নিচে বস্তি গড়ে উঠেছে। তারা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। সন্ধ্যার পরথেকেই এখানে চলে মাদক সেবন।টোকাইদের দখলে চলে গেছে ভিক্টোরিয়া পার্ক। তারা এখানকার পরিবেশ নষ্ট করছে। এগুলো নিয়ে কোনো ব্যবস্থায় নেয়া হচ্ছে না।’

ভিক্টোরিয়া পার্কের আশেপাশেই রয়েছে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,এসবশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরছেলেমেয়েরা এখানে সময় কাটায়। এখানে আসা একটি বড় অংশই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারা সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত এখানে আড্ডা দিয়ে থাকে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী নানা ধরণের স্ট্রিট ফুডের দোকান বসেছে পার্কটিতে।

আশেপাশে খেলার জায়গা না থাকায় বিকেলে এই স্বল্প জায়গাতেই খেলতে আসে আশেপাশের ছেলে-মেয়েরা। বিভিন্ন ঋতুতে তারা বিভিন্ন খেলা করে। ক্রিকেট খেলতে আসা একদল ছেলের সাথে কথা বললে তারা জানায়, আগে পার্কটিতে খেলার জন্য অনেক বড় খোলা জায়গা ছিল। তবে সংস্কারের পর রেস্টুরেন্ট খোলায় খেলার জায়গা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এই ছোট মাঠে খেলাধুলা করা কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বড় করে খেলার মাঠ করার দরকার ছিল।

বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত এখানে হাঁটাহাঁটি ও ব্যায়াম করতে আসে নানা বয়সের লোকজন। এই ছোট্ট জায়গার কারণে তারা ঠিকমতো হাঁটতে ও ব্যায়াম করতে পারেন না। মাসুদ রানা নামক এক ব্যক্তি জানান, ‘আমি ডায়াবেটিসের রোগী। সকাল-বিকাল আমার দুই বেলাই হাঁটতে হয়। তবে সকালে একটু হাঁটতে পারলেও বিকেল বেলা মানুষজনের ভিড় ও নানা ধরনের দোকান গড়ে ওঠায় এখানে হাঁটাই যায় না। ব্যায়াম করার জন্য এখানে কোনো জায়গা নেই। ফলে এই পার্ক থেকে আমরা আশানুরূপ তেমন ফল পাচ্ছি না।‘

পার্কটিতে বসা বিভিন্ন বিক্রেতার সাথে কথা বললে তারা জানায়, এখানে নানা লোকজন আসে, ব্যবসা ভালো হয়। সদরঘাটের মতো জায়গায় পার্কটির অবস্থান হওয়ায় এখানে দেশের নানা জায়গা থেকে লোক আসে।এতে করে পার্কে তাদের ব্যবসা ভালোই হয়।

তবে, নানা কমতি সত্ত্বেও পার্কটি আশেপাশের স্থানীয় মানুষের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়।বিভিন্ন স্ট্রিটফুডের স্বাদনিতে আশেপাশের স্থানীয় লোকজন ছুটে আসে এ পার্কটিতেই। ঐতিহ্যবাহী পার্কটি প্রতিদিনই মুখরিত হয়ে ওঠে নানা বয়সী মানুষের পদচারণায়।একটু সবুজের ছোঁয়া পেতে এখানেই ছুটে এসে স্থানীয়রা।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement